বৃহস্পতিবার; ২০ নভেম্বর ২০২৫; ৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

এফটিএসপি গাইডলাইন: ছায়ার মধ্যে অন্ধকারের অবরোধ ছবি: ইনফোটেকইনসাইট ডট কম

এফটিএসপি গাইডলাইন: ছায়ার মধ্যে অন্ধকারের অবরোধ

-হিটলার এ. হালিম

Published : ১৩:০৯, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

দেশের আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) খাত দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু ২০২৫ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রস্তাবিত 'ফিক্সড টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডার (এফটিএসপি) রেগুলেটরি অ্যান্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইন' এই খাতে এক অভূতপূর্ব অস্থিরতা নিয়ে এসেছে। এই নতুন নীতিমালা আইএসপিদেরকে 'এফটিএসপি' ক্যাটাগরিতে মাইগ্রেট করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করছে, যার ফলে খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের ঝুঁকিতে পড়ছেন। মোবাইল অপারেটরদের একচেটিয়া আধিপত্যের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে এবং সাধারণ গ্রাহকদের জন্য ইন্টারনেট সেবামূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) এই গাইডলাইনের বিরোধিতায় বিটিআরসির সামনে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে, যা খাতের গভীর উদ্বেগের প্রতিফলন।

নতুন গাইডলাইন

বিটিআরসির এই খসড়া গাইডলাইনটি ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছে, যা 'টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং পলিসি ২০২৫'-এর অংশ। এর মূল উদ্দেশ্য টেলিকম খাতকে আরও স্ট্রিমলাইন করা এবং প্রতিযোগিতামূলক করা, কিন্তু বাস্তবে এটি আইএসপি-দের জন্য একটি 'ট্র্যাপ' হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যমান নেশনওয়াইড, ডিভিশনাল, জেলা বা উপজেলা-স্তরের আইএসপি লাইসেন্সধারীদের এখন এফটিএসপি বা ডিস্ট্রিক্ট এফটিএসপি ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করতে হবে। এই স্থানান্তরকে নতুন লাইসেন্স আবেদন হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং পুরনো লাইসেন্সগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। নতুন আইএসপি বা পিএসটিএন (পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক) লাইসেন্সের কোনও আবেদন গ্রহণ করা হবে না।

এফটিএসপি লাইসেন্সটি নেশনওয়াইড কাভারেজের জন্য, যা ফিক্সড ইন্টারনেট, ডেটা, ভয়েস, লিজড লাইন, আইওটি এবং ট্রিপল প্লে সার্ভিস (ভিডিও অন ডিমান্ড-সহ) প্রদানের অনুমতি দেবে। অন্যদিকে, ডিস্ট্রিক্ট এফটিএসপি একটি জেলায় সীমাবদ্ধ। লাইসেন্সের মেয়াদ ১০ বছর, যা কোয়ালিটি অব সার্ভিস (কিউওএস) এবং রোলআউট অবলিগেশনের উপর নির্ভর করে নবায়নযোগ্য। বিদেশি মালিকানা ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদিত, কিন্তু কমপক্ষে ১৫ শতাংশ দেশীয় অংশ থাকতে হবে। এই পরিবর্তনের ফলে আইপিটিএসপি (ইন্টিগ্রেটেড পাবলিক টেলিফোন সার্ভিস প্রোভাইডার) লাইসেন্সগুলোও আইএসপির সাথে মার্জ হয়ে যাবে, যা খাতের ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু হলো মোবাইল অপারেটরদের এফটিএসপি খাতে প্রবেশ। বর্তমানে এরা শুধু মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে, কিন্তু নতুন গাইডলাইনের অধীনে তারা ফিক্সড ব্রডব্যান্ড (যেমন ফাইবার অপটিক ক্যাবলভিত্তিক) সার্ভিস চালু করতে পারবে। এর ফলে তারা ক্যাবল লে করে আইএসপি-দের মতো সেবা দিতে শুরু করলে, দেশীয় আইএসপিরা বাজার থেকে বিতাড়িত হতে পারে। গ্রামীণফোন, রবি এবং বাংলালিংকের মতো কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে ব্রডব্যান্ড মনোপলাইজ করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গাইডলাইন অনুসারে, সেলুলার মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার (সিএমএসপি) লাইসেন্সধারীরা এফটিএসপি নিতে হলে তাদের পুরনো লাইসেন্স সারেন্ডার করতে হবে, কিন্তু বাস্তবে তারা সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে এই খাতে ঢুকছে। এতে আইএসপি খাতের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কারণ মোবাইল অপারেটরদের বিশাল ক্যাপিটাল এবং নেটওয়ার্কের সুবিধা দেশীয়দের সাথে প্রতিযোগিতায় অসম্ভব করে তুলছে। গাইডলাইনে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষার জন্য কিছুই রাখা হয়নি। বাজারে থেকে চলে যাওয়ার যাবতীয় পথ তৈরি করা হয়েছে। যাতে কেউ বাজারে টিকতে না পারলে দ্রুত ওই পথ দিয়ে চলে যেতে পারে।

রেভিনিউ শেয়ার এবং এসওএফ ফান্ডের বোঝা

নতুন গাইডলাইনের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো আর্থিক বাধ্যবাধকতা। এফটিএসপি অপারেটরদের বার্ষিক অডিটেড গ্রস রেভিনিউয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ সরকারের সাথে শেয়ার করতে হবে (প্রথম বছর ছাড়া, কোয়ার্টারলি পেমেন্ট) এবং ১ শতাংশ সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ডে (এসওএফ) দিতে হবে। এছাড়া লাইসেন্স ফি হিসেবে নেশনওয়াইড এফটিএসপির জন্য ২৫ লাখ টাকা অ্যাকুইজিশন ফি, ১০ লাখ বার্ষিক ফি এবং ১৫ লাখ মাইগ্রেশন ফি দিতে হবে। ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে এটি কম (২ লাখ অ্যাকুইজিশন), কিন্তু ছোট আইএসপিদের জন্যও এটি অসহনীয়। আইএসপিএবি অনুমান করেছে, এই খরচের ফলে পাইকারী ক্রয় খরচ ১৪ শতাংশ বাড়বে এবং এন্ড-ইউজার ইন্টারনেটের দাম ১৮ দশমিক ৪ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত  বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে ইন্টারনেট এখনও অ্যাফোর্ডেবল নয়। দেরিতে পেমেন্টের জন্য ১৫ শতাংশ কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট আরোপ করা হয়েছে, যা খাতের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।

মনোপলির ছায়া

মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোন (টেলিনর-নরওয়ে), রবি (অ্যাক্সিয়াটা-মালয়েশিয়া) এবং বাংলালিংক (ভিইওএন-ডাচ) বিদেশি বিনিয়োগের উদাহরণ। নতুন গাইডলাইনের ৮৫ শতাংশ বিদেশি মালিকানার অনুমতি এদের জন্য সুবিধাজনক, কিন্তু দেশীয় আইএসপিদের জন্য এটি মনোপলির ঝুঁকি তৈরি করছে। বিটিআরসির নীতি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ঘোষিত হলেও, এতে ক্রস-সাবসিডাইজেশন নিষিদ্ধ না হলে দেশীয় উদ্যোক্তারা বাজার থেকে সরে যাবে। এর ফলে ডিজিটাল বৈষম্য  বাড়বে এবং দেশের টেলিকম খাত বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাবে।

দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকি

দেশীয় আইএসপিরা মূলত এসএমই-ভিত্তিক, যারা বছরের পর বছর বিনিয়োগ করে ফাইবার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। কিন্তু নতুন ফি, রেভিনিউ শেয়ার এবং মাইগ্রেশনের বাধ্যবাধকতা তাদের তারল্য সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। আইপিটিএসপি খাত, যা ভয়েস এবং ডেটা মার্জ করে, এখন এফটিএসপিতে একীভূত হয়ে যাওয়ায় তাদের সার্ভিস স্কোপ সংকুচিত হচ্ছে। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, এতে বিনিয়োগের রিটার্ন কমবে এবং নতুন প্রবেশ অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে চাকরি হারানোর ঝুঁকি (এ খাতে লক্ষাধিক কর্মী) এবং অর্থনৈতিক অবদান কমবে।

এফটিএসপি গাইডলাইনটি টেলিকম খাতকে আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে নেওয়া হলেও, এর বাস্তবায়ন ছাড়া দেশীয় আইএসপি খাত ধ্বংসের মুখে। সরকারকে গাইডলাইন পুনর্বিবেচনা করে রেভিনিউ শেয়ার কমানো, মাইগ্রেশনের জন্য ইনসেনটিভ দেওয়া এবং মোবাইল অপারেটরদের প্রবেশে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা উচিত। অন্যথায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং গ্রাহকরা দামবৃদ্ধির ভোগান্তিতে ভুগবেন। খাতের স্থিতিশীলতার জন্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে আরও সংলাপ দরকার- যাতে অস্থিরতা না হয়ে স্থায়ীত্ব আসে।

এমএএইচ

শেয়ার করুনঃ